জকিগঞ্জের জয়িতাদের জয়ী হওয়ার গল্প

এ বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পাঁচ নারীকে পুরস্কৃত করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। জকিগঞ্জ উপজেলার এই পাঁচ নারী অসামান্য শ্রম ও প্রতিভায় সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা করে নিয়েছেন। সেই জয়ী হওয়া নারীদের গল্পগুলো যেন অন্যদের প্রেরণা হয়ে দেখা দেয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষা ও চাকরিতে সফল নারী মমতা মালাকার :
মমতা মালাকার, ১৯৬৩ সালের ১লা জুলাই বিয়ানীবাজারের নয়াগ্রামের ডা. কালীপদ কর ও  সমাজকর্মী রীনা রাণী করের রত্নগর্ভা সন্তান। মা রীনা রাণী সমাজকল্যানের সেলাইসহ বিভিন্ন হস্তশিল্পের একজন প্রশিক্ষক ছিলেন। মাকে দেখে শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখে শুরু হয় স্বপ্নের পথচলা। দুই বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় মমতার বাবার লক্ষ্য ছিল সন্তানদের মানুষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। বিয়ানীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও পরে বিয়ানীবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্থরে লেখাপড়ার সময়ে গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের মত বিয়ের প্রস্তাব আসতে ও গ্রামের মানুষের নানা কথা শুরু হলেও পিতার দৃঢ়তা এবং নিজের অদম্য চেষ্টা তা হতে দেয় নি। সফলতার সহিত মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে পরবর্তীতে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে থাকাকালিন সময়ে গ্রামের নিরক্ষর লোকদের স্বাক্ষরজ্ঞান দানের লক্ষ্যে কলেজের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাক্ষরজ্ঞান দানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি গ্রামের হতদরিদ্র মেয়েদেরকে সাবলম্বি করার লক্ষ্যে কাপড় সেলাই ও উলের মেশিনের সাহায্যে সেলাইসহ বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজের প্রশিক্ষন প্রদান শুরু করেন মমতা। আর সেখান থেকেই শিক্ষক হবার স্বপ্ন আরো প্রবলভাবে মনের মধ্যে স্থান দখল করে নেয়। ১৯৮২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত সফলতা লাভের পর বাবা তার স্বপ্ন পুরণের লক্ষ্যে সিলেট পিটিআই এর ১৯৮২-৮৩ সেশনে ভর্তি করান এবং ১ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হযে সবাইকে চমকে দেন। ১৯৮৪ সালে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলো আবেদন করেন মমতা। ভাশেষে ১৯৮৪ সালের ২৫ এপ্রিল তার শিক্ষক হবার স্বপ্ন পুরণ হয়। নিদনপুর মোল্লাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে একজন আদর্শ শিক্ষক হবার পথচলা শুরু হয়ে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুদের সাথে কাজ করে শিক্ষকতা পেশাকে ধীরে ধীরে আপন করে নেন। শিক্ষকতা পেশার প্রতি তার প্রবল ভালোবাসার কারনে জনতা ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ পেয়ে থেকে যান শিক্ষকতা পেশায়। ১৯৮৬ সালে বিয়ে করে জকিগঞ্জের বধু হয়ে আসেন মমতা। স্বামী বীরশ্রী ইউনিয়নের গড়রগ্রামের বাসিন্দা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অমূল্য কুমার মালাকার । সেই সুবাদে ১৯৮৬ সালে জকিগঞ্জ উপজেলার বড়চালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করে জীবনের আরেক নতুন অধ্যায় শুরু করেন। শত প্রতিকূলতা আর কৃষি প্রধান শ্বশুর বাড়ি যৌথ পরিবারে ৩০ জনের অধিক সদস্যের পরিবার সামলিয়ে ২ কিলোমিটার দূরত্বের বর্ষায় কাদামাখা পথ অতিক্রম বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা সুখকর ছিলো না। এতো প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে গিয়েও সমস্যার অন্ত ছিলো না। তার উপর বিদ্যালয়ে ছিলেন মমতাসহ দুইজন শিক্ষক। তা সত্ত্বেও লেখাপড়ার মানের কোনো ঘাটতি না করে কঠোর পরিশ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করা বিশেষ করে মেয়েদেরকে বিদ্যালয়মুখী করার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৮৯ সালে প্রমোশন পেয়েও পরিবার ও যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ থাকায় প্রমোশন নেন নি। মমতা বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে স্বরণীয় দিন ছিলো সেইদিন যেদিন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রীতিলতা ম্যাডাম নিজে বাড়িতে এসে প্রধান শিক্ষক হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। পরে অবশ্য বড়চালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অবসর গ্রহণ করলে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পেয়ে বিদ্যালয়টিকে যুগোপোযুগী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আইসিটি ট্রেনিং সম্পন্ন করে  বিদ্যালয়ে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদানের ব্যবস্থা করে চমক দেখান। সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাশসহ প্রতিবারই সরকারি ও বেসরকারি বৃত্তি লাভ করে বিদ্যালয়ের উত্তোরোত্তর উন্নতির ফলে বিদ্যালয়ের সাথে ক্যাচমেন্ট এলাকার জনগনের সুসম্পর্ক স্থাপিত করেন। যাতায়াত ও পারিপার্শিক অবস্থার উন্নতির ফলে ২০১৮ সালে প্রধান শিক্ষক (চ:দা:) পদে প্রমোশন পেয়ে লক্ষীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তবে বিদ্যালয়টি নব জাতীয়করণকৃত হওয়ার কারণে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরীত ছিলো। বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট এলাকার অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সহযোগীতায় বিদ্যালয়টিকে নতুন রুপে সজ্জিত করে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার হ্রাস করে সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাশ ও ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মূখী করতে সকল শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রাণচঞ্চল করে গড়ে তুলেন। ২০২২ সালের ৩১ মে অবসর গ্রহণের মাধ্যমে তার সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের চাকরি জীবনের সমাপ্তি হয়।মমতার তিন সন্তান তারই আদর্শ অনুসরণ করে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে। বড় ছেলে অলক শুভ্র কর মিশু এমসি কলেজ থেকে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করে লক্ষীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছে। ২য় ছেলে অদ্বিত শুভ্র কর শুভ এমসি কলেজ থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে পইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও ছোট মেয়ে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করে বর্তমানে পীরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত আছে। মমতা মালাকার মনে করেন জীবনে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে না এগুলে সফল হওয়া যায় না।

অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী মরিয়ম বেগম
জকিগঞ্জের কসকনকপুর ইউপির নিয়াগোল গ্রামে ১৯৭৭ সালে  জন্ম নেয়া সরকারী চাকরিজীবী পিতার মেয়ে মরিয়ম মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ১৯৯৯ সালের ২ এপ্রিল আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন থেকেই শুরু জীবনের নতুন অধ্যায়। তিন সন্তানের জননী মরিয়মের ছোট ছেলে মুফিজুর রহমান সিলেট সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণীতে পড়ছে, মেয়ে জোবেদআলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। ২০১৮ সালে টেই্রলারিতার পাশাপাশি শখের বসে কিছু ছাগল কিনে এবং বাড়ির পাশে সবজি চাষ করে বিক্রয় করে সাবলম্বী হয়ে উঠেন মরিয়ম। তার ব্যক্তিগত আয় থেকে ২০১৯ সালে স্বামীকে প্রবাসে পাঠিয়ে থেমে থাকেন নি এই নারী। ২০২০ সালে বড় ছেলে কে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষত করা জন্য যুক্তরাজ্যে পাঠান। তার পর ২০২২ সালে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে পাচঁ বছরের জন্য একটি পুকুর লিজ নিয়ে পরিচর্চা করে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকার মতো ব্যায় করেন। মরিয়ম জানান, এক লক্ষ টাকার মাছ বিক্রয় করেছি। যা আমাকে খুব আনন্দিত করেছে। আমার এই উদ্যোগ দেখে আশে পাশে অনন্য নারীরা অনুপ্রণিত হয়। আমার একটাই লক্ষ নারীরা যাতে সাবলম্বী হয়। তার নিজের পায়ে যাতে দাড়াতে পারে। এতে আমার আত্তার তৃপ্তি মিলবে। আমার উপলব্ধি জীবনে সংগ্রাম না করলে সাফল্য আসে না। এই সফলতা নারী পুরুষ সবার জন্যই সমান। কিন্তু আমাদের সমাজ তা মানতে চায় না। সাফল্যের আরেক নাম সম্মান, যা আজ আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমি মর্ম দিয়ে উপলব্ধি করছি।

সফল জননী নারী রওশন সুলতানা
রওশন সুলতানা, ১৯৭১ সালে জকিগঞ্জের খলাছড়া ইউপির গাগলাজুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক বীরমুক্তিযুদ্ধা মরহুম আব্দুল খালিকের গর্বিত সন্তান। রওশন সুলতানার পিতামহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সিলেট ৫ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে জকিগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ১৯৮৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী বীরশ্রী ইউনিয়নের মাঝরগ্রাম গ্রামের মো: নজরুল হককে বিয়ে করে সংসারী হয়ে যান রওশন। রওশনের স্বামী ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার আয় দিয়েই পরিবারের সকল ব্যয় নির্বাহ হত। ১৯৮৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম সন্তানের জন্মের পর ১৯৯০ সালের ৩রা মার্চ যোগ দেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মী হিসেবে। এর পরে ১৯৯১ সালের ২৩ নভেম্বর আমার ২য় সন্তান, ১৯৯৭ সালে ৩য় সন্তানের জন্ম হয়। বড় সন্তান এসএসসি পাশ করার পর সিলেটের একটি কলেজে পড়ালেখা করছে। বাড়িতে বসবাসের উপযুক্ত ঘর না থাকায় ঋণ করে একটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ছেলেমেয়েদের ভালো লেৃখাপড়া করানোর জন্য সিলেট শহরে একটি বাসা ভাড়া দেন। শহরে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া তদারকি করার জন্য তাকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে বাড়ি থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরের সিলেট শহরে যাতায়াত করতে হত। এজন্য চাকরি ও সংসারের হাল একসাথে সামলানো তার জন্য সহজ ছিল না। এতকিছুর পর এখন তার মনে এই সান্তনা যে, সংগ্রাম করেছেন বলেই তার সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। বড়ছেলে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে। ২য় ছেলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে সাইনটিস্ট হিসেবে কর্মরত আছে। আমার একমাত্র মেয়ে সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাশ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করছে।
রওশন সুলতানা বলেন, জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞাতা থেকে উপলব্ধি, জীবনে সংগ্রাম না করলে সফল হওয়া যায় না। আর সফলতার আরেক নাম সম্মান, যা আজ আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমি মর্ম দিয়ে উপলব্ধি করছি

সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখা শিউলী রাণী
শিউলি রানী রায় ; জন্ম জকিগঞ্জ উপজেলার খলাছড়া ইউপির মুলীকান্দি গ্রামে। একটি সংগ্রামী জীবন যাপনের মাধ্যমে তার বড় হয়ে ওঠা।  ৬ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় শিউলী। বাবা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের একজন সহকারী ছিলেন এবং মা গৃহিনী। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বাবার গলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে নানা আর্থিক সংকটে সংসার চলছিল তাদের। সেই সময় থেকে টিউশনি সংসার চালাতে হতো তাদের। শিউলী জানান, বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা এতো অভাবে ছিলাম, ক্যালেন্ডার এর পিছনের সাদা পাতায় অংক করে আমাকে এসএসসি পরিক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়েছিলো। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় হাফছা মজুমদার মহিলা ডিগ্রি কলেজ যাওয়ার বাস ভাড়া পর্যুন্ত আমাকে অনেক সময় সহপাঠীরা দিয়ে সাহায্যে করতো। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য যে বই গুলো দরকার সেগুলো কিনতে পারিনি। কলেজ লাইব্রেরীর বই ব্যবহার করতাম। কলেজ এর স্যার ম্যাডামরা আমাকে মাসিক বেতন মওকুফ করে দিতেন।
ডিগ্রি পাশের পর মাস্টার্সে সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে ভর্তি হলে ভাগ্যক্রমে এমএ পড়ার সময়ে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরিক্ষা দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পান। দিনে চাকুরির কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর রাতের বেলা টিউশনি করিয়ে ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। বর্তমানে তার ছোট ভাইকে এমবিবিএস পড়াচ্ছেন যাতে  ডক্তার হয়ে গরীব মানুষকে সেবা দিতে পারে।
২০১৩ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সোনাতুল গ্রামের সবুজ কান্তি সরকারের সাথে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে ভুলবুঝাবুঝির কারনে বিয়ের ৬ মাসের মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তখন শিউলী ২ মাসের অন্তসত্তা ছিলেন। পরে যথাসময়ে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হলে সন্তানের বাবা সন্তানের কোন খোজ-খবর নেয় নি। সন্তানের সকল খরচ শিউলী বহন করেন। তার মেয়ে এখন ৩য় শ্রেনীতে পড়ে। সে পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো। পড়াশুনার পাশাপাশি সে নিত্য, গান, চিত্রাংকন, আবৃতিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সে ২০২২২০২৩ সালের জাতীয় শিশু পুরুস্কার প্রতিযোগিতা ও প্রাথমিক শিক্ষা পদক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে সিলেট জেলা পর্যায়ে ‘ক’ গ্রুপে ৩ বার ১ম স্থান অর্জন করে।
জকিগঞ্জের কালিগঞ্জ বাজারে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সাংস্কৃতিক আলো দিশারী’ এর সক্রিয় সদশ্য হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এই সংগঠনে ছোট ছোট শিশুদের বিনা বেতনে গান, চিত্রাংকন, আবৃতি, ও নৃত্যের ক্লাস পরিচলনা করা হয়। প্রত্যন্ত এই এলাকার যেখানে সংস্কৃতির চর্চা কল্পনাতীত, সেখানে তিনি কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে এই অসম্ভব কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলে এই সংগঠনের শিশুরা জাতীয় শিশূ পুরুস্কার প্রতিযোগিতা ও প্রাথমিক শিক্ষা পদক প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে ‘ক’ গ্রুপে নৃত্যে ৪ বার ১ম স্থান ও কবিতা আবৃতিতে ১বার ১ম স্থান অর্জন করে।
এলাকার অনেক দরিদ্র শিশু আছে যারা দারিদ্রতার জন্য প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারেনা। বাড়িতে তাদের বাবা মায়ের সাথে কাজে সাহায্যে করতে হয়। যার ফলে তারা পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়ে। একসময় তারা ঝরে পড়া শিশুতে পরিনত হয়। এসব শিশুদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে তিনি তাদের সন্তানদের সেচ্ছায় মজার ছলে পড়া শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যাতে তারা পড়া শিখতে ভয় না পায়। আবার অনেক গরিব শিক্ষার্থীদের তিনি সাধ্যমতো শিক্ষা উপকরণ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
তাছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি এর জকিগঞ্জ উপজেরা পর্যায়ের একজন সক্রিয় সদস্য তিনি। প্রত্যেক মহিলাদের বাড়ির সামনে কৃষিকাজ করার পরামর্শ প্রদান করে গ্রামের মহিলারা যাতে শাক-সবজি ফলমূল ইত্যাদি গাছ লাগায় সে বিষয়ে পরামর্শ প্রদান, যাতে তারা নিজেদের চাহিদা পূরনের পাশাপাশি বাড়তি শাখ-সবজি ও ফলমূল বিক্রি করে কিছু আয় করতে পারে।
এছাড়াও গ্রামের দরিদ্র মহিলা ও মেয়েদের বেকারত্বের কথা চিন্তা করে ৩ মাসের দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে মহিলা ও শিশুদের সবধরনের কাপড় সেলাই, সেচ্ছায় এই সব দরিদ্র মহিলা ও মেয়েদের কাপড় সেলাইয়ের কাজ শিখাচ্ছেন। শিউলী তার এলাকার একজন দরিদ্র মহিলাকে একটি সেলাই মেশিন দিয়েছেন।
শিউলী বলেন, নিজেই আমি একজন ভাগ্য বঞ্চিত মানুষ। এজন্য অসহায় দরিদ্র মানুষদের ভাগ্যেন্নয়নে সারাজীবন কাজ করে যাব।

ফারহানা আক্তার ঝুমি ; জকিগঞ্জের ইনামতি গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ৭ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ফারহানা ঝুমি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত কর লুৎফর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের কারিগরি শাখা থেকে মাধ্যমিক পাশ করে হাফসা মজুমদার মহিলা কলেজে ভর্তি হন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু পরিবারের চাপে একাদশ শ্রেণিতে উঠেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর ভালোই যাচ্ছিল তার সংসার।এক বছর পর বড় মেয়ের জন্মের পর শুরু হয় তার উপর মানসিক ও শারিরীক ভাবে নির্যাতন। কারন তার ছেলে জন্ম হয়নি মেয়ে জন্ম নিলো কেন। সবাই পরামর্শ দিলো সহ্য করে থাকো সব ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়ে সংসার করে যাচ্ছিলেন, এরপর আবারও ২য় মেয়ের জন্ম হলে তার উপরে আরো শারিরীকভাবে নির্যাতন শুরু হয়। পরপর দুটি মেয়ের জন্ম দেওযার কারনে প্রবাসী স্বামীর সাথে প্রায়ই ঝগড়া লেগেই থাতো সংসারে। এক পর্যায়ে স্বামীর বাড়িতে না থাকতে পেরে চলে আসেন বাবার বাড়ি। পরে স্বামীর সাথে যোগাযোগ করে জকিগঞ্জ পৌরসভার পীরেরচক গ্রামে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। স্বামী দেশে এসে কেছরী গ্রামে জায়গা কিনে বাসা বানানোর কাজ শুরু করেন। তখন পরিচয় হয় বালু ব্যবসায়ীর সাথে। সেই সুবাদে বালু ব্যবসায়ীর স্ত্রীর প্ররোচনায় আবারো শুরু হয় নির্যাতন। পরে তার স্বামী বিদেশ চলে গেলে ঐ মহিলার দায়িত্বে দিয়ে যান তাকে। কিছুদিন পর আবারো আরেকটি মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে শুরু হয় অকথ্য গালিগালাজ, এক পর্যায়ে ঐ মহিলার কারনে তার জন্য খাবারও বন্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যন মাজেদা রওশন শ্যামলীর স্মরনাপন্ন হলে তিনি জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাওলানা আফতাব আহমদের সাথে যোগাযোগ করে তার স্বামী সাথে আলোচনা করেন। কিন্তু কোনো সুরাহা না হওয়ায় একরকম অসহায়ের মত সংগ্রামী সংসার চালিয়ে নিয়ে যান। মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে কোন গৃহ শিক্ষক ছাড়াই মেয়েরা ভালো রেজাল্ট করে এগুচ্ছে। বর্তমানে তার বড়মেয়ে জকিগঞ্জ  সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। দ্বিতীয় মেয়ে হাফিজ মজুমদার শিক্ষা ট্রাষ্ট বৃওি পরিক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পায়। সুযোগ পেয়ে যায় সাজ্জাদ মজুমদার বিদ্যানিকেতনের প্রতিভা নিবাসে। ছোট মেয়ে ভরন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকে পড়ে। এক মেয়েকে প্রতিভা নিবাসে দিয়ে শুরু হলো বাকি দুই মেয়েকে নিয়ে যুদ্ধ। এরই মধ্যে উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরাম থেকে ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা রওশন শ্যামলী মাধ্যমে একটি সেলাই মেশিনে সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ পান।হঠাৎ একদিন শুনতে পারেন তার স্বামী দেশে এসেছে। ভাবলেন, হয়ত মেয়েদের কথা ভেবে হলেও বাসায় আসবেন।  কিন্তু সে এসে এক তাকে মেরে বাসা থেকে বের করে দিতে চাইলে কোনো রকমে নিজেকে রক্ষা করেন এবং মেয়েদের চিৎকারে আশে পাশের লোক চলে আসলে বেরিয়ে যায় তার স্বামী। এরপর থেকে শুরু হয় বাসার বাইরে দাড়িয়ে খারাপ লোক নিয়ে সারা রাত আড্ডা । পরে বাধ্য হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে বিষয়টি জানালে তিনি স্বামীকে ডাকলে স্বামী জানান, সংসার করবেন না, ডির্ভোস দিতে চান। ইউএনওর সাথে পরবর্তী তারিখে বৈঠকের কথা বলে তার স্বামী আবারো  বিদেশ চলে যান লুকিয়ে। প্রাইভেট পড়িয়ে, সেলাই করে সংসার সংসার চালানোর পাশাপাশি চাকরির খোজ করতে থাকেন। একসময় প্রজন্ম রিচার্জ ফাউন্ডেশনে পেয়ে যান চাকুরী। সকালে বড় মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ডিউটিতে বের হয়ে, বিকেলে বাসায় ফিরে সংসার দেখা, মেয়েদের পড়ালেখার খোজ নেয়া সবই সামলান নিজ হাতে। তিনি তার মেয়েদের বাবা এবং মা দুজনেরই দায়িত্ব পালন করে চলছেন। বুঝতে দেন না বাবার অভাব। মেয়েরা তার কাছে মূল্যবান রত্ন। তাদেরকে তিনি ঝামেলা মনে করেন না। বর্তমানে সকল সমস্যা পিছনে ফেলে একা সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন এই নারী। তিনি জানান, এখন মেয়েদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাচ্ছি। আমি নারী, আমি সাহসী, আমি অপরাজিতা।

নবীনতর পূর্বতন