রাওদ্বা শরীফের ইতিবৃত্ত

মারজান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী
১১ হিজরির (৬৩২ খ্রি.) রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার দিন আমাদের প্রিয় নবী ﷺ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। বিয়োগব্যথার কিয়ামতসম ধাক্কা সামলানোর আগেই সাহাবায়ে কেরামের সামনে প্রশ্ন আসে, দাফন কোথায় হবে? মিম্বরের পাশে, জান্নাতুল বাকীতে, মক্কা শরীফে— নানা মত আসতে থাকে। তখন আবু বকর সিদ্দীক রা. বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, নবীরা যে জায়গায় ইন্তেকাল করেন, সেখানেই দাফন হওয়া পছন্দ করেন।” সিদ্ধান্ত হয়, আয়েশা সিদ্দীকা রা. এর হুজরার ভেতর যে বিছানায় রাসূলুল্লাহ ﷺ ইন্তেকাল করেছেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হবে। কবর খনন করার দায়িত্ব দেয়া হয় সাহাবি আবু তালহা রা. এর হাতে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে গোসল দেন আলী, আব্বাস, ফাদ্বল ইবনে আব্বাস, কুছাম ইবনে আব্বাস এবং আযাদকৃত গোলাম শুকরান রাদ্বিআল্লাহু আনহুম আজমাঈন।

এরপর আসে জানাযার প্রশ্ন। সাহাবিরা কেউ রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সামনে রেখে জানাযায় ইমামতি করতে রাজি ছিলেন না। তাই ছোট ছোট দল বেধে প্রথমে পুরুষ, পরে নারী এবং সবশেষে শিশুরা হুজরার ভেতরে গিয়ে যারযার মতো সালাত-সালাম পাঠ করে জানাযা আদায় করেন। সোম-মঙ্গলবার গিয়ে বুধবারের রাতে দাফনের কাজ সমাপ্ত হয়। যারা গোসল দিয়েছিলেন, তারাই রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে কবর শরীফে নামান।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কবর শরীফ পূর্ব-পশ্চিমে। অর্থাৎ মাথা পশ্চিমদিকে, পা পূর্বদিকে, চেহারা মোবারক সামান্য ডানে কাত করে দক্ষিণে কিবলার দিকে ফেরানো। মাটির উপরিভাগ থেকে কবরের উচ্চতা ছিল চার ইঞ্চি উঁচু, দেখতে অনেকটা উটের কুঁজের মতো। কবরের ওপর লাল নুড়িপাথর ছড়ানো ছিল। আড়াই বছরের মাথায় রাসূল ﷺ এর কবরের উত্তর পাশে সামান্য নিচের দিকে সরিয়ে দাফন করা হয় আবু বকর রা.-কে। আরও দশ বছর পর আরেকটু উত্তর দিকে উমর রা.-কে। ৫৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করার আগ পর্যন্ত আয়েশা রা. কবর শরীফের পাশেই বাকি জীবন পার করেছিলেন। তবে উমর রা.-কে দাফন করার পর তিনি কবর ও নিজের বিছানার মধ্যখানে পর্দা টানিয়ে দিয়েছিলেন। জনসাধারণের জন্য কবর শরীফের পাশে গিয়ে যিয়ারত করার অনুমতি ছিল না। লোকজন সচরাচর হুজরা শরীফের বাইরে দাড়িয়ে সালাত-সালাম পাঠ করতেন।

৯১ হিজরিতে (৭১০ খ্রি.) উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেন। ততদিনে উম্মাহাতুল মু'মিনীন সবাই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও তাঁদের হুজরাগুলো ৯০ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে মসজিদের পূর্বপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছিল। এ জায়গার মালিকানা ছিল আহলে বায়েতের কাছে। দুঃখজনকভাবে ওয়ালিদ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীদের সবগুলো হুজরা ভেঙ্গে কবর শরীফসহ পুরো জায়গাটি মসজিদের ভেতর অন্তর্ভুক্ত করার আদেশ দেন। তাবেয়ীন, উলামা, আহলে বায়েতের সদস্যরা বারবার মানা করলেও ওয়ালিদ কারও কথা আমলে নেননি। মসজিদ সম্প্রসারণের দায়িত্ব পড়ে মদীনার তৎকালীন গভর্নর উমর ইবনে আবদুল আযীযের হাতে, যিনি তখনও কেবল এক 'উমাইয়া রাজকুমার'। যে উমর ইবনে আবদুল আযীযকে আমরা চিনি, তিনি তখনও তা হয়ে উঠেননি।

উমর ইবনে আবদুল আযীয হুজরাগুলো ভেঙ্গে দেন। কাজ চলাকালীন একটি কবরের মাটি খানিকটা সরে গিয়ে সেখানে একটি অক্ষত পা দৃশ্যমান হয়েছিল। লোকজন একে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পা মনে করে শ্রদ্ধায়-সমীহে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। পরে মদীনার আলিমগণ সবাইকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, এটি উমর রা. এর পা। কবর শরীফের চারপাশে হুবহু আয়েশা রা. এর হুজরার মাপ অনুসারে কালো পাথরের একটি চারকোণী (Square) বন্ধ দেয়াল নির্মাণ করা হয়। অর্থাৎ মাটির ওপরে হেটে কবর শরীফের পাশে যাওয়ার কোনো পথ রাখা হয়নি। ১ম ছবিতে সবচেয়ে ভেতরে যে নীল রঙের দেয়াল দেখতে পাচ্ছেন, এটিই সেই বন্ধ দেয়াল। একইসাথে দেয়ালটির নিরাপত্তার জন্য এর বাইরে আরেকটি দেয়াল তৈরি করা হয়। ছবিতে লাল রঙের যে পাঁচকোণী (Pentagonal) দেয়াল দেখতে পাচ্ছেন, এটি সেই দেয়াল। এই দেয়ালে ছোট একটি দরজা ছিল।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দেহ মোবারক বহুবার রাওদ্বা শরীফ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। কুখ্যাত ফাতেমি শাসক আল-হাকিম দু'বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। ৫৫৭ হিজরিতে (১১৬১-৬২ খ্রি.) দুজন খ্রিস্টান দূর থেকে সুড়ঙ্গ খুড়ে কবরের ভেতরে গিয়ে দেহ মোবারক সরানোর অপচেষ্টা করেছিল। সুলতান নূরউদ্দীন জঙ্গী রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে স্বপ্নে দেখে মদীনায় যান এবং ওদেরকে খুঁজে বের করে হত্যা করেন। তখন তিনি হুজরার চারপাশে মাটির নিচে একটি অভেদ্য সীসার দেয়াল তৈরি করে দেন। দেয়ালটি ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক নিচুতে থাকায় ওপর থেকে এর অস্তিত্ব বুঝা যায় না।

৬৫৪ হিজরিতে (১২৫৬ খ্রি.) মসজিদে নববী এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়। দুর্ঘটনাবশত একজন খাদিমের হাত থেকে তেলের পাত্র ছিটকে পড়ে পর্দায় আগুন লেগে যায়। মূহুর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রচণ্ড উত্তাপে মসজিদের ছাদ ধ্বসে পড়ে রাওদ্বা শরীফের দেয়ালের ওপর। আগুন নেভানোর পর শ্রদ্ধাবশত দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ না করে মদীনাবাসী পত্র মারফত খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহকে বিষয়টি অবগত করেন। ওদিকে রাজধানী বাগদাদে তখন বাজছিল আব্বাসি খেলাফতের বিদায়ঘন্টা। বাগদাদকে ঘেরাও করে রেখেছিল হালাকু খানের দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনী। তাই খলিফার কাছ থেকে কোনো জবাব আসেনি। অর্থের অভাবে মসজিদে নববীও মেরামত করা হয়নি।

বিশ্বজুড়ে সীমাহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে রক্তের বন্যা ভাসিয়ে দেয়া বর্বর মোঙ্গল বাহিনীর জয়যাত্রা ১২৬০ সালে আইন জালুত যুদ্ধে থামিয়ে দিয়েছিলেন 'ইসলামের চিতাবাঘ' মামলুক সুলতান রুকনুদ্দীন বাইবার্স। ৬৬৮ হিজরিতে (১২৬৯ খ্রি.) সুলতান বাইবার্স মসজিদে নববী পুনঃনির্মাণ করেন। তিনি উমর ইবনে আবদুল আযীযের তৈরি দেয়ালে হাত না দিয়ে বরং এর চারপাশে বড় জায়গা নিয়ে একটি কাঠের সীমান্ত-দেয়াল তৈরি করে দেন। দেয়ালটি উত্তরদিকে ফাতিমা রা. এর হুজরাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ৬৭৮ হিজরিতে (১২৭৯ খ্রি.) রাওদ্বা শরীফের ওপর সর্বপ্রথম একটি কাঠের গম্বুজ নির্মাণ করেন মামলুক সুলতান আল-মানসুর কালূন।

৮৮৬ হিজরির (১৪৮১ খ্রি.) এক ঝড়বৃষ্টির রাতে মুয়াজ্জিন যখন এশার আযান দিচ্ছিলেন, ঠিক তখন মসজিদের মিনারে এক প্রকাণ্ড বজ্রপাত হয়। ছাদসহ মিনারটি ভেঙ্গে পড়ে এবং মুয়াজ্জিন সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। বজ্রপাতের ফলে আগুন লেগে দ্বিতীয়বারের মতো পুরো মসজিদে নববী ধ্বসে পড়ে। সেবার রাওদ্বা শরীফের দেয়ালদুটিও অনেকাংশে ভেঙ্গে গিয়েছিল। মামলুক সুলতান আল-আশরাফ কাইত্ববাই মসজিদ পুনঃনির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তবে তার আগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবলোকন করার জন্য তিনি হুজরা শরীফ, অর্থাৎ চারকোণী দেয়ালের ভেতরে লোক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে বিগত ৬শ বছর থেকে কেউ প্রবেশ করেনি। সিদ্ধান্ত হয়, সে সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম ইমাম আলী ইবনে আহমদ সামহুদী হুজরা শরীফের ভেতরে যাবেন। লাখো মানুষকে বাইরে রেখে ভাঙ্গা দেয়ালের তলা দিয়ে কোনোমতে ভেতরে প্রবেশ করেন সৌভাগ্যবান ইমাম সামহুদী। তিনি তাঁর বিখ্যাত আল-ওয়াফাউল ওয়াফা কিতাবে লিখেছেন, ভেতরের মাটি বাইরের তুলনায় অনেক নিচু। প্রবেশ করামাত্র এমন এক সুগন্ধ এসে নাকে লাগল, যার সাথে অন্য কোনো ঘ্রাণের তুলনা হয় না। এত বছরে মাটি সমান হয়ে গিয়েছিল বলে কবরগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করার উপায় ছিল না। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেন, হুজরা শরীফের মাটি একদম সিক্ত, তরতাজা। তিনি ওই পাক মাটিতে হাটার সাহস করেননি। আবেগে-শ্রদ্ধায়-ব্যাকুলতায় ভাঙ্গা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ধরাপৃষ্ঠে আল্লাহর রহমতের সবচেয়ে বড় মানযার, রাহমাতুল্লিল আলামীন ﷺ এর কবর মোবারক চোখের সামনে রেখে ইমাম সামহুদী মনের সব আকুতি মিশিয়ে সালাত-সালাম পাঠ করতে থাকেন। ওই মহাসৌভাগ্যবান ব্যক্তি তখন কী অনুভব করেছিলেন, জানি না। তবে লেখার সময় সে দৃশ্যটি কল্পনা করে বারবার আমাকে নিজের চোখ মুছতে হয়েছে।

ইমাম সামহুদী সর্বশেষ ব্যক্তি, যিনি চারকোণী দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন। সেই দিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আর কেউ হুজরা শরীফের ভেতরে যায়নি, যাওয়ার উপায় নেই, যাওয়া উচিৎও নয়। কাইত্ববাই আগের দেয়ালদুটিকে ঘিরে তৃতীয় আরেকটি দেয়াল তৈরি করেন, যেটি সবদিক থেকে বন্ধ। ছবিতে পাঁচকোণী দেয়ালের বাইরে কমলারঙের যে আঁকাবাঁকা দেয়াল দেখতে পাচ্ছেন, এটিই সেই দেয়াল। বর্তমানে এই দেয়ালের ওপর গিলাফ চড়ানো থাকে, যা দশ বছর পরপর পরিবর্তন করা হয়। বাইবার্সের নির্মিত সীমান্ত-দেয়াল ভেঙ্গে কাইত্ববাই একই মাপে সেখানে একটি ধাতব জালি তৈরি করেন। ছবিতে একেবারে বাইরে যে সবুজ দেয়াল দেখা যাচ্ছে, এটিই সেই জালি এবং তা আজও বিদ্যমান। আমরা (পুরুষরা) এই জালির বাইরে দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে সালাত-সালাম পাঠ করি। আমরা যেখানে দাঁড়াই (২য় ছবি), সেখান থেকে কবর শরীফ প্রায় দশ ফিট দূরে, তিন-তিনটি দেয়ালের ভেতরে। কাইত্ববাই রাওদ্বা শরীফের ওপর একটি ইট-সুরকির গম্বুজ নির্মাণ করেন। প্রথমে এর রঙ ছিল সাদা, পরে নীল। ১৮১৮ সালে উসমানি (অটোমান) সুলতান ২য় মাহমুদ গম্বুজটি পুনঃনির্মাণ করেন। ১৮৩৭ সালে সুলতান আবদুল হামিদ ওই গম্বুজে সবুজ রঙ দেন। উসমানি আমলে রাওদ্বা শরীফে আরও কিছু ছোটখাটো সংস্কার করা হয়েছিল।

সৌদি আমলে রাওদ্বা শরীফে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। জালির ভেতরে প্রবেশ করার জন্য বর্তমানে শুধু পূর্বপাশে একটি দরজা রাখা রয়েছে (৩য় ছবি)। কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অতি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জালির ভেতর প্রবেশ করে গিলাফ চড়ানো দেয়ালের পাশে যেতে পারেন। সেখানে পরিচ্ছন্নতার কাজ সাধারণ কর্মীদের দ্বারা করানো হয় না। এ দায়িত্বটি পালন করেন মদীনার বিশিষ্ট আলিম-উলামা। এভাবেই নির্মাণ-পুনঃনির্মাণের মধ্য দিয়ে মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পূর্বকোণে সাড়ে চৌদ্দশ বছর ধরে উম্মাতের ঈমানের ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় নবী ﷺ এর রাওদ্বা মোবারক।

نفسي الفداء لقبر أنت ساكنه فيه العفاف وفيه الجود والكرم

তথ্যসূত্রঃ সহীহ বুখারী, সুনান আবি দাউদ, সুনান আত-তিরমিযী, দালাইলুন নুবুয়্যাহ, সীরাতে ইবনে হিশাম, তাবাকাত ইবনু সা'দ, তারিখুল মাদীনাহ।

নবীনতর পূর্বতন