লতিফিয়া মসজিদে মারামারি : কার মাথায় বাড়ি পড়লো, মাথা ফাটলো কার?

মাহমুদুর রহমান চৌধুরী ::::
জকিগঞ্জ পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডে লতিফিয়া জামে মসজিদের সাথে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আমি জড়িত ছিলাম। বিধায় প্রবাসে আসার পরও এ মসজিদ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখি। গত শনিবার তারাবীর সময় যে মারামারি হয়েছে, অনলাইন ও ফোনের মাধ্যমে আমি বিভিন্ন জনের নিকট থেকে তা জেনেছি।
এ বিষয়ে "জকিগঞ্জ আই টিভি"র বিস্তারিত ভিডিও রিপোর্ট দেখেছি। আমি নিজে ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তারপরও ভিডিও দেখে বেশ ফাকফোকর আমার চোখে পড়ছে। আপনারাও ভালো ভাবে দেখলে চোখে পড়বে।
প্রথমত মসজিদটির অবস্থান হাইদ্রাবন্দ, আলমনগর ও পীরের চক গ্রামের মাঝখানে। এটি হাইদ্রাবন্দ গ্রামের কোন মসজিদ নয়। অথচ ভিডিওতে বারবার হাইদ্রাবন্দ জামে মসজিদ বলা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি হাস্যকর হয়েছে এই প্রতিবেদনের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হাইদ্রাবন্দের আব্দুস সালামের সাক্ষাৎকার। তিনি দাবি করেছেন, রেদওয়ান ও শাহান মাওলানা হুসাইনকে দুই দিক থেকে ধরে রেখেছে, আর জুনেদ মাইকৈর স্ট্যান্ড দিয়ে তার মাথায় বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, তার হাতে "ডেগারও" ছিল। অথচ মাওলানা হুসাইনের ছেলেসহ অনেকে ফেসবুকে তার সারা শরীরে আঘাতের চিহ্নের ছবি/ভিডিও পোস্ট করেছেন, কোন কিছুতেই তার মাথা ফাটার ছবি নাই। আর ডেগার যদি থাকতো, তাহলে সেই ডেগার দিয়ে হামলা করলে তো হুসাইনের অবস্থা আরো গুরুত হতো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার শরীরে ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছাড়া গুরুতর কোন জখম নাই। অন্য দিকে মাওলানা হুসাইন ও তার সহযোগীদেল হামলায় নজরুল ও রেদওয়ানের মাথা ফেটেছে। তাদের দুজনের মাথা ফাটার ছবি ঐ ভিডিওতেও আছে। তাহলে আমার প্রশ্ন, "কার মাথায় বাড়ি পড়লো, আর মাথা ফাটলো কার???" অর্থাৎ আসলে মাওলানা হুসাইন নয়, মার খেয়েছেন রেদওয়ান ও নজরুল, কিন্তু কথিত প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুস সালামের ভূয়া সাক্ষীতে পুরো ঘটনা উল্টে গেছে।
ঐ ভিডিওতে স্থানীয় কাউন্সিলর বললেন যে এক পক্ষ নাকি মাওলানা হুসাইনকে রক্তাক্ত করেছে। তিনি এর বিচার দাবি করেছেন। তার কথা শুনে মনে হতে পারে শুধু মাওলানা হুসাইনই মার খেয়েছেন অপর পক্ষের হাতে। অথচ এই ভিডিওতেই দেখলাম মাওলানা হুসাইনের তুলনায় অপর পক্ষের দুই জন বেশি গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের দুই জনের মাথা ফেটেছে মাওলানা হুসাইনদের সন্ত্রাসী আক্রমণে। মাওলানা হুসাইনের গুরুতর মাথায় বা এরকম কোন জায়গায় কোন জখমই দেখা গেলো না, ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছাড়া। জনপ্রতিনিধি হয়েও তিনি একপাক্ষিক বক্তব্য দিলেন, প্রকৃত সত্য স্বীকার করলেন না।
ভিডিওতে হাইদ্রাবন্দের জনৈক মহসিন আহমদের সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছে। তার বক্তব্য থেকে জানা গেলো ঐ দিন যুহরের পর মাওলানা হুসাইনের বাসায় সাবেক মেয়র ফারুকসহ তারা বিশ পঁচিশ জন মিটিং করেছেন। আমরা জানলাম, ঐ দিন আছরের সময় মাওলানা হুসাইন ইমামকে ঘাড়ে ধরে বের করতে চাইছেন, তারাবীর সময় মারামারি শুরু করেছেন। তাহলে কী ঐ মিটিঙে যারা ছিলেন, তারাই মাওলানা হুসাইনের পিছনের মদদদাতা?
মহসিন আরো বললেন আটটার দিকে নাকি তিনি "হুজুরের ওয়াইফের" ফোন পেয়ে তার ভাই বেরাদর নিয়ে এসেছেন। আটটার সময় তো মসজিদে আযান হয়েছে মাত্র, ঘটনা শুরুই হয়নি। যখন শুরু হয়েছে তখন বেশির ভাগ মানুষের মসজিদে থাকার কথা নামাজে। মহসিন ও তার চাচাতো ভাইরা ঐ সময় মসজিদে ছিলেন, নাকী মাওলানা হুসাইনের ওয়াইফের ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন? তবে কি দিনের মিটিঙের কারণে তারা আগে থেকেই জানতেন তারাবীর সময় মাওলানা হুসাইন মারামারি শুরু করলে সেখানে যাওয়া লাগবে?
আর মাওলানা হুসাইন যদি আগে থেকে প্রস্তুত না হতেন, তাইলে ঐ সময় বারগাত্তা থেকে ডেগার মোল্লাসহ আরো অনেকে মসজিদে আসলো কীভাবে?
মাওলানা হুসাইন তার বক্তব্যেও অনেক উল্টাপাল্টা বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন মসজিদ নাকি তিনি বানাইছেন। অথচ এই মসজিদ ফুলতলীর বড় ছাহেব কিবলা বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন তারা তিন-চার জন নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ বানাইছেন। আমি মসজিদ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ছিলাম। বিধায় জানি তিন-চার জনের জন্য মসজিদ বানানো হয় নি। তিনি বলেছেন জকিগঞ্জ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ভাইস প্রিন্সিপাল ইমাম রেখেছেন। শুনে মনে হতে পারে উনারা জোর করে রেখেছেন। আসলে উনারা মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীল, উনারাসহ মসজিদ কমিটির সকলে মিলে নিয়মমাফিক ইমাম রেখেছেন। কেউ ব্যক্তিগত ভাবে রাখেন নি।
তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি ঐ দিন তারাবীর সময় নামাজ পড়ানোর জন্য এসেছিলেন। আসলে তিনি মারামারি শুরু করার জন্যই সময়ের আগে নামাজ পড়াতে চেয়েছিলেন। কমিটি তাকে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেয়নি। সময়ও নির্ধারণ করা ছিল সোয়া আটটা, তিনি এসে আট মিনিট আগে শুরু করতে চান।
মাওলানা হুসাইন দাবি করলেন তাকে রড, মাইকের স্ট্যান্ড, হাতুড়ি, পাথর এইসব দিয়ে মারা হয়েছে। এতো বেশি মার খাইলে তো তার হাসপাতালে থাকার কথা, এক দিন পর তিনি কীভাবে কালিগঞ্জে গিয়ে ঈদের নমাজ পড়ালেন? আসলে তার তেমন কিছুই হয়নি, ঐ সময় অভিনয় করেছেন। নজরুল মিয়ার মাথা তিনিই ফাটাইছেন মাইকের স্ট্যান্ড দিয়ে, তার মাথায় কেউ বাড়ি মারে নাই। পরে নিজে থেকে গিয়ে মসজিদে ঢুকে শুয়ে পড়েছেন।
কমিটি তার দাবি মেনে নিয়ে ইমামকে নামাজ পড়াতে না করেছিলেন, এট স্বীকার করে আবার তিনি দাবি করলেন ভাইস প্রিন্সিপাল হুজুর ও তার ছেলেরা নাকি ইমামকে দিয়ে নমাজ পড়ানোর জন্য হামলা করিয়েছেন বা করেছেন। অথচ ঐ দিন ভাইস প্রিন্সিপাল হুজুর অসুস্থ থাকায় তারাবীর সময় মসজিদে ছিলেন না, আর ইমামকে দিয়ে নামাজ পড়ানোর কথাও চেও বলে নি, বরং ভাইস প্রিন্সিপাল হুজুরসহ কমিটির সবাইই ফিতনা থেকে বাঁচার স্বার্থে মাওলানা হুসাইনের অযৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে বদলি ইমামের ব্যবস্থা করেছিলেন।
জকিগঞ্জ আই টিভির ঐ ভিডিওতে তারা যেসকল বক্তব্য নিয়েছে সে সব বক্তব্যে এরকম আরো অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। খেয়াল করে শুনলেই সেগুলো যে কেউ বুঝতে পারবেন।
নবীনতর পূর্বতন