শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, নেই হোমওয়ার্ক, নেই কোচিংয়ে যাওয়ার তাড়া। গৃহশিক্ষকেরও আপাতত বিরতি। প্রাত্যহিক পাঠাভ্যাস ছুটির শুরুর দিকে যা-ও ছিল, এখন তাতেও ঢিলেমি। অনেক দিন হয়ে গেল এভাবেই চলছে। এভাবে একটানা পড়ালেখা থেকে বিরত থাকতে থাকতে বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ছুটিকালীন বাসায় সন্তানের লেখাপড়ার জন্য শুরুতে তারা ছিলেন সিরিয়াস। এখন অধিকাংশ অভিভাবকই আপাতত সন্তানের সুস্থ থাকার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা ছুটির শুরুতে লেখাপড়ায় যতটা মনোযোগী ছিল ক্রমেই তা কমছে। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে করোনা নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক আছে, যা দিন দিন বাড়ছে।
ছুটিতে বাসায় কেমন লেখাপড়া হচ্ছে-এ প্রশ্নে জকিগঞ্জের একটি স্কুলের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আতকিয়া আজিজা নিঝুম বলল, আগে পড়তাম। এখন পড়ায় মন বসে না। ওর মা স্কুল শিক্ষিকা রেহানা উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, বন্ধে তো লেখাপড়া একেবারে শেষ। নভেম্বরে জেএসসি পরীক্ষা। কী হবে? কী করব?
কিছুই বুঝতে পারছি না। স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট সব বন্ধ। বাসায় নিজে নিজে পড়ার যে চেষ্টা ওর ছিল, এখন তাও নেই।
পৌরশহরের একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মীম সবুজ প্রান্তকে জানায়, স্কুলের পড়া নেই, বাসায় ছুটি। রোজ একটু একটু পড়তে বসে। তার বাবা দেলোয়ার হুসেন নজরুল বলেন, অনেক চাপ দিয়েও মেয়েকে লেখাপড়ায় বসাতে পারি না। সারাদিন টিভি দেখে সময় যাচ্ছে।
গনিপুর কামালগঞ্জ স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নিজেও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তিনি বলেন, এখন আসলে বাচ্চার সুস্থতা নিয়ে বেশি ভাবছি। লেখাপড়া কিছু না কিছু হবে। ছুটির শুরুর দিকে দেখেছি, বাসায় বই নিয়ে বসছে। এখন তেমন একটা বসেও না। বেশি চাপও দিই না। করোনা নিয়ে ওর মধ্যে একটা উদ্বেগ কাজ করছে। আমরা যতটা পারি বোঝাতে চেষ্টা করি। নিজেরাও ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছি।
জকিগঞ্জ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তুলি ও কলির অভিভাবক হেলাল উদ্দীন জানান, স্কুলের হোমওয়ার্ক দিতে হবে-মেয়েদের মধ্যে আগে এমন চাপ কাজ করত, এখন সেই চাপ নেই। বাচ্চাদের স্বভাব, চাপে না পড়লে লেখাপড়া করতে চায় না। টেলিভিশনের সংবাদ দেখে ওদের প্রশ্ন করোনা কী ঘরে আসবে? আমরা কী স্কুলে যেতে পারব না? তাদের মনে ভীতি কাজ করছে।
ছুটিকালীন লেখাপড়া এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের করণীয় সম্পর্কে থানাবাজার লতিফিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা শিহাব উদ্দীন খাদিমানী সাপ্তাহিক সবুজ প্রান্তকে বলেন, অন্য যে কোনো ছুটির তুলনায় এবারের ছুটি ভিন্ন। আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়মিত মাদ্রাসায় যাওয়া, বাড়ীতে হোমওয়ার্ক, টিউটরদের কাছে লেখাপড়া করা-এমন একটা ছকের মধ্যে চলার অভ্যাস। এসব থেকে একটু বেরোতে পারলে শিক্ষার্থীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এর মধ্য দিয়ে তাদের মানসিক একটা প্রশান্তি কাজ করে। কখনো ছেলেমেয়েকে পড়ার জন্য বাড়তি চাপ দিতে হয় না। এতে বাচ্চারা মানসিক চাপে পড়ে, সহজে লেখাপড়াই আয়ত্ত করতে পারে না। তিনি রামাদান মাসে শিক্ষার্থীদের ঘরে থেকে সহীহভাবে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত চর্চার আহবান জানান।
নিজেও অভিভাবক জানিয়ে তিনি বলেন, আমার দুই সন্তান মাদ্রাসা পড়ুয়া। আমি তাদের পড়ালেখা নিয়ে কোনো চাপ দিই না। বরং এখন তাদের স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর দিচ্ছি। বেশ খারাপ লাগছে রামাদান মাসে দারুল কেরাত বন্ধ থাকার কারনে।
অভিভাবকদের উদ্দেশে তার ভাষ্য, করোনার ছুটিতে বাসায় স্বাস্থ্যসস্মত জীবনযাপনের চর্চা করুন। ছেলেমেয়েদের চর্চা করতে অভ্যস্ত করুন। তাদের চাপমুক্ত লেখাপড়ায় আগ্রহী করুন। বেশী বেশী আল্লাহর জিকির, কুরআন তেলাওয়াত চর্চার পরিবেশ গড়ে তুলুন। করোনা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করুন, এটি উৎকণ্ঠার বিষয় না-বোঝাতে হবে। পারিবারিক বন্ধনে ছেলেমেয়েদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। এর মাধ্যমে মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নীত হবে। ফলে লেখাপড়ায় ছেলেমেয়েরা ভালো করবে।
ছুটিকালীন লেখাপড়া প্রসঙ্গে জকিগঞ্জ আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ কাজী হিফজুর রহমান সবুজপ্রান্তকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ এটি যেমন শিক্ষার্থীদের কাছে বেদনাদায়ক হতে পারে আবার আনন্দদায়কও হতে পারে। কারণ এ সময়টায় লেখাপড়ায় আরও বেশি স্বাধীন তারা। তাদের কোনো নিয়মিত ছকেবাঁধা পাঠ্য বিষয়, প্রশ্ন-উত্তর, বিজ্ঞান, গণিতের হোমওয়ার্ক নেই। পড়ার কোনো সময়সূচিও বাধাধরা নেই। এ স্বাধীনতাকে শিক্ষার্থীরা সঠিক কাজে লাগাতে পারলে পরীক্ষার ফল নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে না। তবে ৫ম শ্রেণি থেকে এর নিচের ক্লাসগুলোর শিক্ষার্থীরা শিক্ষক ছাড়া লেখাপড়ার সটিক দিকনির্দেশনা পায় না, যার কারনে বর্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থার সাথে বেশীরভাগ অভিভাবক সটিক দিকনির্দেশনা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এই মুহুর্তে দীর্ঘ ছুটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
শিক্ষক নজমুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীরা বইবিমুখ হবে কেন? সরকার টেলিভিশনে পাঠদান সম্প্রচার করছে। এখানে হোমওয়ার্ক দেওয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্লাস নিচ্ছে অনলাইনে। অভিভাবকদের একটু সচেতন হতে হবে। বাচ্চাদের জোরজবরদস্তি করে নয়, বন্ধুসুলভ আচরণে বোঝাতে হবে। পুরো দিনের কিছুটা সময় যেন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় ব্যয় করে।
দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর গত ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্থগিত করা হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। বিলম্ব হচ্ছে এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে লেখাপড়ার ক্ষতি আরও দীর্ঘ হতে পারে।