জুবায়ের আহমদ ::::
একবিংশ শতাব্দিতে গোটা বিশ্বসমাজ এক অভাবনীয় পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্চে। বস্তুত, পাশ্চাত্য কৃ্ষ্টি-কালচারের প্রভাবে প্রভাবিত আধুনিক বিশ্বসমাজ সামাজিক ভাইরাসের আক্রমনে জর্জরিত। সমাজের রক্তকনিকাগুলো এসব ভাইরাসের আঘাতে নিস্তেজ হয়ে যাচ্চে। ফলে সমাজ ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণুর পথে এগুচ্চে। পরিবারের দ্রুত অবক্ষয়ই এর প্রধান কারন।
মাত্র কিছুদিন পূর্বেও যে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সভ্যতার ভিত্তিস্বরুপ ছিলো; যে বৈবাহিক বন্ধন মানুষের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বূ্যহ হিসেবে পরিগনিত হতো, সে পরিবার আজ আচমকা ঘূর্ণি হাওয়ার কবলে নিপতিত। মানবোচিত গুণরাজিমালায় সুশোভিত মানুষের জন্য যুগ-নীতিহীনতা, কুটিলতা ও পাশবিক প্রবৃত্তির জোয়ারে খড়কুটোর ন্যায় ভেসে যাচ্চে। সমাজের এহেন প্রবাহমান ধারার প্রতি ইঙ্গিত করে জনৈক সমাজবিজ্ঞানী বলেন, যদি আমরা কল্পনায় আমাদের ২০০০ অব্দে নিয়ে যাই এবং বিংশ শতাব্দির প্রথম পচিশ বছরের মানবীয় ঘটনাবলীর সবিশেষ বৈশিষ্ট্য কি ছিলো জিজ্ঞাসা করি, তাহলে আমরা অনুধাবন করবো যে, মহাযুদ্ধ নয়, রাশিয়ার বিপ্লবও নয় বরং নারী জাতির মর্যাদার পরিবর্তনই সেই সবিশেষ বৈশিষ্ট্য। এতো অল্প সময়ে এমন চমকপ্রদ পরিবর্তন ইতিহাস খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে।
তথাকতথিত নারী স্বাধীনতা, নারী পুরু্ষের অবাধ মেলামেশা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীদের নির্বিচার অংশগ্রহন পারিবারিক পরিবেশেকে কলুষিত করেছে এবং পারিবারিক কাঠামোকে ঘুণে ধরিয়ে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্চে। স্বভাবজাত দায়িত্বের কথা ভু্লে তারা পুরু্ষের সাথে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। অবশ্য নারী সমাজকে ঘরের বাইরে টেনে আনার পিছনে তথাকতথিত প্রগতিশীল পুরু্ষের ভূমিকাই মুখ্য।
সন্তান ধারন ও মাতৃত্ব লাভ নারীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানু্ষের গড়া অপূর্নাঙ্গ ও বিভ্রান্ত সমাজদর্শনের প্রভাবের ফলে নারীরা এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে গায়ের জোরে ভু্লে যাবার প্রয়াস পাচ্চে। মানব বংশকে এ দুনিয়ায় টিকিয়ে রাখার এই উপায়কে তারা অপমানজনক কাজ হিসেবে দূরে ঠেলে দিতে চাচ্চে। হোটেলে, পার্কে, পথেঘাটে, সমুদ্র-সৈকতে হরদম অবৈধ মেলামেশা ও অসামাজিক কর্ম করে চলেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও কুমারী মাতাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
কোমলতা নারী জাতির স্বভাবজাত সৌন্দর্য। বাইরের পরিবেশে এসে নারীরা তাদের কোমলতা ও নারীত্বকে বিসর্জন দিয়েছে। আসলে বাইরের কাজে নারী আর নারী থাকে না। নারীকে ঠিক পুরু্ষের সমপর্যায়ে সমাসীন করে নারীর নারীত্বের অবসান ঘটানো হয়েছে।
আমরা দেখেছি, পরিবারের সংহতি ও সুখ-সমৃদ্ধি বিনষ্ট হওয়ার দরুন আধুনিক সমাজ অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার রোগে ভোগছে। মানব জীবনে দেখা দিয়েছে নিরাশা-নিরাপত্তাহীনতা, অধিকাংশের জীবনে বিতৃষ্ণা প্রকট হয়ে দাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিকে আমরা অসভ্য ও বর্বর সমাজের সাথে তুলনা করতে পারি, যা কালের প্রভাহে সভ্যতার পরিমাপে টিকতে না পেরে ধ্বংসের কবলে বিলীন হয়ে গেছে।
গ্রীক সভ্যতা :
প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রীক সমাজ সুপরিচিত। প্রথমদিকে গ্রীক জাতি সামাজিক আচার-আচরণ ও নৈতিক দৃ্ষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে নিম্ন মানের ছিলো। তখন বিশেষ করে নারীর অধিকার ও মর্যাদা ছিলো না বললেই চলে। গ্রীকরা নারীদের নিকৃষ্ট জীব হিসেবে চিহ্নিত করত। তারা ছিলো তাদের কাছে অমঙলের প্রতীক। কিন্তু আস্তে আস্তে সভ্যতা ও জ্ঞানের আলোর পরশ যখন তারা পেতে লাগলো, তখন নারী কিছুটা সামাজিক মর্যাদা পেলো। নারীদের গৃহের কর্ত্রী করা হলো। তাদের সতীত্ব রক্ষা করাকে পবিত্র কর্ম হিসেবে গণ্য করা হতো। গ্রীক পরিবারগুলোতে পর্দার প্রচলন হলো। ঘরের ভিতরে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক ব্যাবস্থা করা হলো। বিবাহপ্রথাকে সম্মানজনক অনুষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। নারী-পুরু্ষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হলো। এমনিভাবে সুশৃঙ্খল ও স্থিতিশীল পারিবারিক পরিবেশের সুশীতল ছায়ায় থেকে গ্রীক জাতি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির চরম শিখরে উন্নীত হয়।
কিন্তু তৎকালীন সভ্যতার সুউচ্চ মার্গে পৌছার পর গ্রীক জাতির জীবনে আবার পতন শুরু হয়। বেশ্যাবৃত্তি, ব্যভিচার, অনাচারে ছেয়ে গেলো পুরো গ্রীক সমাজ। শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অনৈতিকতা ও ব্যভিচারের নিকৃষ্টতম বহিঃপ্রকাশ ঘটতে লাগলো; মানববংশ বৃদ্ধি ও যৌন বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য বিবাহকে অনাবশ্যক মনে করতে লাগলো। শুরু হলো কামদেবীর পূজা। গ্রীক পুরানে কামদেবী সম্পর্কে এরুপ বর্ণিত আছে যে, সে জনৈক দেবতার পত্নী হয়ে অপরাপর তিনজন দেবতা এবং একজন মানবের সঙ্গে প্রেমপূর্ণ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। এদের যৌন মিলনের ফলে যে সন্তান লাভ হলো, পরবর্তি সময়ে সে-ই কামদেব নামে অভিহিত হয়। এই কামদেব গ্রীকদের উপাস্য ছিলো। এটা অনুমান করা কঠিন নয় যে, যে জাতি এরুপ জঘন্য চরিত্রকে শুধু তাদের আদর্শ নয, উপাস্য হিসেবে গ্রহন করেছিলো, তাদের নৈতিক মানদন্ড কত নিচুস্তরের ছিলো। গ্রীক জাতির এহেন নৈতিক অধঃপতনের পর আর তাদের পুনরুত্থান সম্ভব হয়নি।
রোমান সভ্যতা :
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তি রোমান সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠশতকে রোম শহর ছিল এক অখ্যাত দূর্বল রাষ্ট্র। এ রোম শহরকে কেন্দ্র করেই শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্য সারা ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করে। মাত্র ১০০ বছরের ব্যাবধানে রোম সাম্রাজ্যের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিশ্বের বুকে এক উজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত হয়। উন্নতি-সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে প্রবাহমান অবস্থায় রোম সাম্রাজ্যের পারিবারিক বন্ধন ছিলো অত্যন্ত সুদৃঢ়। নারী-পুরুষের মধ্যে কর্মের বিশেষীকরণ ছিল। পুরুষেরা বাইরের সকল কাজে নিয়োজিত থাকতো আর নারীরা গৃহশিল্পে ব্যাপৃত থাকতো। গৃহের এই সুখী-সুন্দর পরিবেশই শেষ পর্যন্ত তাদের শ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদায় আসীন করে।
এভাবেই রোমানদের নৈতিকতা ও সম্ভমশীলতা অত্যন্ত উচ্চমানের ছিলো। একবার রোমান সিনেটের জনৈক সদস্য আপন কন্যার সামনে তার স্ত্রীকে চুম্বন করেছিল। এই ঘঠনার দ্বারা জাতীয় চরিত্রের প্রতি কঠোর অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং সিনেটগৃহে তার বিরুদ্ধে ভৎসনাসূচক ভোট প্রদত্ত হয়।
কিন্তু সমৃদ্ধির চরম শিখরে পৌছার পর রোমানদের জীবনে দেখা দিল পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতা। নারীদের ঘরের বাইরে টেনে আনা হল এবং তাদের যথেচ্চ স্বাধিনতা দেয়া হল। বিলাস-ব্যসন, জাঁক-জমক, মদ-জুয়া-সাকীতে ডুবে রইল তারা। সামান্য একজন নারীর আঙ্গুল হেলনে রাজমুকুট একজনের মাথা থেকে অন্যজনের মাথায় শোভা পেত। নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এমন এক পর্যায়ে পৌছলো যে, তারা তাদের স্বামীদের উচ্চহারে সুদে টাকা ধার দিত। ঋণের ভারে স্বামী বেচারা স্ত্রীর দাসে পরিণত হতো। বিবাহ বন্ধন নিছক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ছিল। নারী কর্তৃক তালাক প্রদান এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, নারীরা তার স্বামীর সংখ্যা দ্বারা নিজের বয়স গণনা করত।
এহেন নাজুক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রোমান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হল। বিশাল রোম সাম্রাজ্য দূর্বল নারীদের হাতে একে একে পতন হতে লাগল। রোম সাম্রাজ্যের পতনের যুগের ভয়াবহ সামাজিক পরিস্থিতি আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজেও প্রচ্চন্ন। রোমের গণতান্ত্রিক সরকারের পরবর্তি যুগে শাসকমন্ডলী ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা লাস্যময়ী এবং বিলাসপ্রিয় নারীদের নিয়ে মত্ত থাকতেন। এ ধরনের নারী সে যুগে যথেষ্ট পাওয়া যেত। ঠিক সেদিনের সে অবস্থা আজও দেখা যাচ্চে। আজও নারীদের দিকে তাকালে পরিস্কার বুঝা যায় যে, তারা বিলাস-ব্যসনে যেন আপদমস্তক ডুবে চলেছে। এ নেশা তাদের মাতাল করে তুলছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় প্রসার, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশায় উদ্ভূত পরিস্থিতি, পারিবারিক পরিবেশকে কলু্শিত করে তুলছে এবং ঘর ভাঙ্গার নমুনা দেখে কেউ কেউ আশংকা করেছেন যে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে পরিবার কালের গহবরে বিলীন হয়ে যাবে।
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন আধুনিক যুগের মনোবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, ভবিষ্যতের জটিল, সংকট-সংকুল জীবনে মানুষ বাধ্য হয়ে সুখ ও শান্তি পাবার আশায় পরিবারের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হবে। সমাজ জীবনের জটিলতা যত বেশী বৃদ্ধি পাবে, পরিবারের প্রতি আকর্ষণও সে অনুপাতে তত বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমেরিকার এফবিআই-এর সাবেক পরিচালক এডগার জে হুভার বলেন, মার্কিন জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে পরিশীলিত পারিবারিক পরিবেশের যথার্থ সংরক্ষণ করতে হবে।
আমরাও দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলতে পারি যে, বিশ্বের মানবসভ্যতা-সংস্কৃতি এবং মানবোচিত গুনরাজির অব্যাহত স্রোতধারার স্বার্থে পরিবারের অস্তিত্ব একান্ত অপরিহার্য।