মুহাররম ভাবনা : মুখোশধারি রাফিযীদের প্রোপাগাণ্ডা

মাও. আব্দুল আউয়াল হেলাল ::::
বাংলাদেশে দিনকে দিন রাফিযী ও খারিজী আকীদার প্রসার ঘটছে নীরবে নিভৃতে। যে দুই পক্ষ চেতনে অবচেতনে তা করছে তারা কেউই নিজেদের রাফিযী-খারিজী পরিচয় দিতে প্রস্তুত নয়। সমাজে এদের পরিচয় ভিন্ন। তাই সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে সচেতন উলামায়ে কিরামের বলিষ্ঠ তৎপরতা একান্ত কাম্য। সচেতনতা বৃদ্ধির আশায় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়েই কলম হাতে নেয়া ।

রাফিযী প্রোপাগাণ্ডা:
বিগত কয়েক বছর হলো বিষাদের মাস মুহাররাম এলে বাংলাদেশে সুন্নি নামধারি রাফিযী চিন্তা চেতনা ও আকীদা লালনকারি কিছু মানুষ সায়্যিদিনা মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করতে দেখা যায়। তাদের কেউ কেউ ইতিহাসের কিছু অসংলগ্ন তথ্য উপাত্তকে সামনে নিয়ে এসে স্বভাব সুলভ কদর্য ভাষায় প্রকাশ্যে আক্রমণ সানায় কাতিবে ওহী মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর উপর। বাংলার মুসলমান এদের অতীত বর্তমান মোটামুটি জানে এবং তাদের ফেরেববাজি সম্পর্কে সচেতন রয়েছে।কিন্তু সুন্নিয়তের মুখোশের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কিছু রাফিযী/শিয়া ইনিয়ে বিনিয়ে আহলে বাইত’র মুহাব্বাত প্রকাশের নাম করে মালউন ইয়াযীদ’র যাবতীয় অপকর্মের দায় চাপাতে চায় মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর উপর।এরা খুবই খতরনাক,কারণ মুখোশের অন্তরালে ঢেকে রাখা তাদের রাফিযী তথা শিয়া আকীদা সম্পর্কে সাধারণ সুন্নি মুসলমান ততটা সচেতন নয়।

এই মুখোশধারিরা ইতিহাসের বিভিন্ন ফাঁক ফোকর তালাশ করে তাদের চিরায়ত স্বভাবের কুযুক্তির মাধ্যমে রাফিযীয়াতের খড়গ চালিয়ে পরোক্ষভাবে মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে খিয়ানতকারি, চরিত্রহীন, লম্পট ইত্যাদি প্রমান করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। কেউ কেউ আরো এক কাটি এগিয়ে বলে তিনি মুসলমানই ছিলেন না। তাঁর ইসলাম গ্রহন ছিলো প্রহসন, আদতে মুনাফিক ছিলেন। আল ইয়াযু বিল্লাহ।
কারো চিন্তাধারা, ইজতিহাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করা এক কথা আর তাঁর চরিত্র হননে লিপ্ত হওয়া ভিন্ন কথা। উল্লেখ্য যে, মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর রাজনৈতিক কিছু ইজতিহাদের সাথে দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে। তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত উম্মাহর জন্য সামগ্রিকভাবে কল্যাণকর প্রমানিত হয়নি।কিন্তু এই অজুহাতে তাঁর চরিত্র হননের মত হীন কাজ আহলুসসুন্নাহ’র ইমামগণ অনুমোদন করেন না।

মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহনের সময়কাল সম্পর্কে ইতিহাসে দু’টি মত প্রসিদ্ধ আছে। প্রথম মত হলো অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের দিন তিনি এবং তাঁর পিতা- মাতা ও ভাই একই সাথে ইসলাম গ্রহন করেছেন। দ্বিতিয় মত ষষ্ঠ হিজরিতে হুদাইবিয়া সন্ধিকালে তিনি মুসলমান হয়েছেন।মক্কা বিজয়ের পর হুনায়িন অভিযানকালে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিবেদিত সৈনিক হিশেবে দায়িত্ব পালন করেণ।

পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ওহি লেখক নিয়োগ করেণ।
১২ হিজরিতে সায়্যিদুনা আবুবাকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার মুসাইলামাতুল কাযযাব বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ইয়ামামার যুদ্ধে মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বীরত্বের সাথে লড়াই করেণ।

২১ হিজরিতে দ্বিতিয় খলীফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রথমে তাঁকে জর্দান এবং পরে দামেস্কের গভর্ণর নিযুক্ত করেণ।
২৩ হিজরিতে তৃতিয় খলীফা উসমান যিননূরাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে পুরো শামের গভর্ণর নিয়োগ করেণ।

উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে কয়েকটি জিজ্ঞাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিন মুনাফিকের পার্থক্য বুঝতেন না ? যারা মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মুনাফিক প্রমান করতে চায় পক্ষান্তরে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাজকে পরোক্ষভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ করে। একজন মুনাফিককে কেমন করে তিনি ওহি লেখক নিয়োগ করলেন ?

খলীফা উমার এবং উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমা একজন খিয়ানতকারি, চরিত্রহীনকে গভর্ণর নিয়োগ করলেন ? মূলত: চরমপন্থী রাফিযী তথা শিয়ারা প্রথম তিন খলীফার কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে নানাবিধ প্রোপাগাণ্ডা চালিয়েছিলো। বাংলাদেশে সে কাজটিই ভিন্ন আঙ্গিকে এখন করছে কথিত সুন্নি মুখোশধারি রাফিযীরা।

আহলুসসুন্নাহ’র ইমামগণ মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একজন নিষ্ঠাবান সাহাবী হিশেবে নিজেদের সাহাবী চরিত বিষয়ক কিতাবে তাঁর জীবনী উল্লেখ করেছেন। যেমন- ইমাম ইবনু আবদিল বার ( ৩৬৮-৪৬৩ হিজরি)- আল ইসতিআব ফী মা’রিফাতিল আসহাব খণ্ড ৩ পৃষ্ঠা ১৪১৬, ইমাম ইবনুল আছীর ( ৫৫৫-৬৩০ হিজরি)- উসদুল গাবাহ ফী মা’রিফাতিসসাহাবাহ খণ্ড ৫ পৃষ্ঠা ২০৯, ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী ( ৭৭৩-৮৫২ হিজরি)- আল ইসাবাহ ফী তাময়িযিসসাহাবাহ খণ্ড ৬ পৃষ্ঠা ১১২।
এবার দেখা যাক একজন সাহাবীর চরিত্র হনন, গালমন্দ, দোষারোপ বৈধ কী না । সাহাবয়ে কিরামকে গালমন্দ করতে নিষধ করেছেন স্বয়ং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।যেমন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَأَبِي سَعِيدٍ رَضِيَ الله عَنْهُمَا قَالَا: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: "لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيفَهُ". حديث أبى سعيد: أخرجه الطيالسى (ص 290 ، رقم 2183) ، وأحمد (3/54 ، رقم 11534) ، وابن أبى شيبة (6/404 ، رقم 32404) ، وعبد بن حميد (ص 287 ، رقم 91 ، والبخاري (3/1343 ، رقم 3470) ، ومسلم (4/1967 ، رقم 2541) ، وأبو داود (4/214 ، رقم 465 ، والترمذى (5/695 ، رقم 3861) وقال : حسن . وابن حبان (16/238 ، رقم 7253) . حديث أبى هريرة : أخرجه مسلم (4/1967 ، رقم 2540) ، وابن ماجه (1/57 ، رقم 161) . وأخرجه أيضًا : الطبرانى فى الأوسط (1/212 ، رقم 687)
হযরত আবু হুরাইরা ও হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- তোমরা আমার সাহাবীদের গালমন্দ করোনা,তোমরা আমার সাহাবীদের গালমন্দ করোনা। আমার যথাসর্বস্ব যার হাতে সেই সত্বার শপথ ! তোমাদের কেউ যদি ওহুদ পাহাড় সমপরিমান সোনা আল্লাহর রাহে খরচ করো তবু তাঁদের এক অথবা অর্ধেক মুদ এর সমান হবে না।
( মুদ- তখনকার সময়ে মদীনা শরীফে প্রচলিত ওজনের বাটখারা বিশেষ।)

উপরোক্ত হাদীস শরীফখানা ইমামা বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী, ইমাম ইবনু মাজাহ, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমূখ নিজ নিজ কিতাবে সংকলন করেছেন। আরবি অংশে কিতাবসমূহের রেফারেন্স সবিস্তারে আছে।

শরহে মুসলিমে এই হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
وَاعْلَمْ أَنَّ سَبَّ الصَّحَابَة رَضِيَ اللَّه عَنْهُمْ حَرَام مِنْ فَوَاحِش الْمُحَرَّمَات، قَالَ الْقَاضِي: وَسَبُّ أَحَدهمْ مِنْ الْمَعَاصِي الْكَبَائِر،
জেনে রাখুন, সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে গালমন্দ করা নিকৃষ্টতম হারামের মধ্যে একটি। কাযী আয়ায বলেছেন, যেকোন সাহাবীকে গালমন্দ করা কবিরা গোনাহ।

সাহাবায়ে কিরামকে গালমন্দ করা, তাদের সমালোচনা, দোষারোপের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্নভাবে সতর্ক করেছেন। এ বিষয়ে বহু হাদীস উল্লেখ করা যায়।কলেবর চিন্তায় আমরা তা উল্লেখ করলাম না। সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত’র আকীদা আলোচনায় ইমাম আবু জা’ফর আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ তাহাবী ( ২৩৮-৩২১ হিজরি) রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
لا نذكرهم الا بخير، وحبهم دين وايمان واحسان، وبغضهم كفر ونفاق وطغيان.
আমরা তাঁদের ( সাহাবীগণের) উত্তম ছাড়া আলোচনা করবো না। তাঁদের মুহাব্বাতই দ্বীন, ঈমান এবং ইহসান। আর তাঁদের প্রতি হিংসা পোষণ হলো কুফরি, মুনাফিকী এবং সীমালঙ্ঘন। [ আল আকীদাতুত তাহাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৪২ ]

সুতরাং ইতিহাস চর্চা কিংবা গবেষণা যে কোন অজুহাতেই হোক সাহাবায়ে কিরামের সম্মানহানিকর আলোচনা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত’র আকীদায় নিষিদ্ধ ।

নবীনতর পূর্বতন