মাও. আবদুল আউয়াল হেলাল ::::
ইসলামের ইতিহাসে কুখ্যাত এক নাম ইয়াযিদ। এ জাতির দুর্ভাগ্য যে, যুগে যুগে এমন মানুষের জন্ম হয়েছে যারা ইয়াযিদকে নির্দোষ প্রমানে ইতিহাসের অলি গলি চষে বেড়ায়। বর্তমান বাংলাদেশে আহলে হাদীস নামধারী কয়েকজন কথিত শায়খ ইয়াযিদের পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে মিথ্যা হাদীস রচনার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন ইতোমধ্যে।তারা এও বলতে চান যে, ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর হ্রদয় বিদারক শাহাদতের জন্যে ইয়াযিদ দায়ি নয়। ইয়াযিদ নাকি কারবালা হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দাতা নয়। এবিষয়ে ইতিহাসের নানা তথ্য উপাত্ত নিয়ে নানা কথা বলার সুযোগ হয়তো আছে।তবে আমরা ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি রাহিমাহুল্লাহর গবেষণা এবং ইলমি আমানতদারির প্রতি গভীর আস্থা পোষণ করি।কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পূর্বাপর আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম সুয়ূতি বলেন-
وبعث أهل العراق إلى الحسين الرسل والكتب يدعونه اليهم، فخرج من مكة متوجهاً إلى العراق في عشر ذى الحجة ومعه طائفة من آل بيته رجالاً ونساء وصبياناً، فكتب يزيد إلى واليه بالعراق عبيد الله بن زياد بقتاله ، فوجه اليه جيشاً أربعة آلاف ............. لعن الله قاتله وابن زياد معه ويزيد أيضاً .( تاريخ الخلفاء ، ص ٣٤١)
অর্থাৎ ইরাকের জনগণ হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বহু দূত ও পত্র প্রেরণ করে। ফলে যিলহাজ্জ মাসের দশ তারিখে তিনি মক্কা মুকাররামা থেকে ইরাক অভিমূখে রওয়ানা দেন।সাথে ছিলেন তাঁর পরিবারের নারী, পুরুষ এবং শিশুগণ।তখনই ইয়াযিদ ইরাকে নিযুক্ত তার গভর্ণর উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের প্রতি হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহুকে হত্যার নির্দেশপত্র দিয়ে চার হাজার সেনা প্রেরণ করে।........... হুসাইন রাদিল্লাহু আনহুকে হত্যাকারি ইবন যিয়াদ এবং ইয়াযিদের উপর আল্লাহ লানত বা অভিশাপ বর্ষণ করুন। ( তারীখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা ৩৪১)
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কর্তিত মস্তক দামেশকে ইয়াযিদের দরবারে যখন রাখা হয় সে হাতে থাকা ছড়ি দিয়ে দাঁত মুবারকে আঘাত করতে করতে কবিতা আবৃত্তি করেছিলো-
ليت أشياخي ببدر شهدوا جزع الخزرج من وقع الأسل
لاهلوا واستهلوا فرحاً ثم قالوا يا يزيد لا تشل
অর্থাৎ হায় ! বদর যুদ্ধে নিহত আমার পূর্ব পুরুষরা যদি আজ থাকত, তবে আজকের বিজয় গাঁথা দেখে তারা খুশিতে আমায় অভিনন্দন জানিয়ে বলতো, হে ইয়াযিদ তোমার উদ্যোগ বৃথা যায় নি। তুমি যথাযত প্রতিশোধই নিয়েছো। (সিলসিলাতু আবায়িননাবী পৃষ্ঠা ১৯২)
সুতরাং কারবালা ট্র্যাজেডির মাস্টার মাইণ্ড যে ইয়াযিদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যারা আজ সহীহ হাদীসের অনুসরণের নামে সাধারণ মুসলমানের মাঝে বহুমূখি ফিতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে, কারবালা হত্যাকাণ্ডের হুকুম দাতা ইয়াযিদকে নির্দোষ সাধু পুরুষ প্রমানে ব্যর্থ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, ইয়াযিদের সাথে সাথে তাদের উপরও আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক ।
কারবালা ঘটনা ছাড়াও তো ইয়াযিদ লানত বা অভিশাপের উপযুক্ত। হাররার ঘটনা বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে চুম্বক অংশ সামনে নিয়ে আসলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে ইয়াযিদ নিন্দাবাদ বা অভিশাপের উপযুক্ত কি না।
৬২ হিজরির ঘটনা। সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন হানযালা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র নেতৃত্বে মদীনা তায়্যিবাহ থেকে একটি প্রতিনিধি দল দামেশক যায়। ইয়াযিদ তাঁদের প্রতি খুবoই সম্মান প্রদর্শন করলো। নানা উপহার দিয়ে মন জয় করতে চেষ্টা করলো। প্রতিনিধি দল ফিরে এলে গণ চাহিদার প্রেক্ষিতে দলনেতা হযরত আবদুল্লাহ ইবন হানযালা রাদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে নববীর মিম্বরের পাশে দাঁড়িয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন।বললেন- ইয়াযিদ আমাকে অনেক সম্মান দেখিয়েছে, এমনকি এক হাজার দিনার উপঢৌকনও দিয়েছে। তবু বলবো, সে নর্তকী পরিবেষ্টিত হয়ে মদ পান করে, নামাযের প্রতি ভ্রুক্ষেপই করেনা।হেন কোন অপকর্ম নেই যা সে করে না। এমতাবস্থায় আমরা তার বাইআত ছিন্ন করে যদি প্রতিবাদ মুখর না হই তবে আমি আশংকা করি আসমান থেকে আল্লাহ আমাদের উপর গজবের পাথর বর্ষণ করবেন।ইয়াযিদের অপকর্মের এই বর্ণনা প্রত্যক্ষ দর্শী একজন সাহাবীর মুখে শোনার পর তাৎক্ষণিক মদীনাবাসি প্রতিবাদে ফেঁটে পড়লো। তাঁরা মদীনায় ইয়াযিদ নিযুক্ত গভর্ণর মারওয়ান ইবন হাকামকে গৃহবন্দী করে রাখলো। সংবাদ পেয়ে ইয়াযিদ মুসলিম ইবন উকবার নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য পাঠালো। ইবন উকবাকে এই নির্দেশ দিলো যেনো মদীনাবাসিকে চুড়ান্ত শায়েস্তা করার পর মক্কা অবরোধ করে এবং আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ির রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করে।
সময় মত মুসলিম মদীনা নগরীর অদূরে হাররা নামক স্থানে সৈন্য সমাবেশ করলো। ৬২ হিজরির ২৮ যিলহাজ্জ বুধবার প্রিয় নবীর প্রিয় শহর মদীনার উপর আক্রমণ করে।আবদুল্লাহ ইবন হানযালা রাদিয়াল্লাহু আনহুমার নেতৃত্বে মদীনাবাসি প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁদের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে পড়লো। ইয়াযিদ বাহিনী নির্বিচারে নরহত্যা চালিয়ে ৮০ জন সাহাবীসহ কমপক্ষে দশ হাজার মানুষ হত্যা করলো। তিন দিন পর্যন্ত মদীনাকে হালাল ঘোষণা করা হলো। ফলে অবাধ লুটতরাজ এবং ব্যাপক নারী ধর্ষণের মত জঘন্য কাজ চালানো হলো। গণধর্ষণের ফল স্বরূপ পরবর্তীতে এক হাজার পিতৃ পরিচয়হীন শিশুর জন্ম হলো। এই তিন দিন মসজিদে নববীতে আযান ইকামাত পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে সৈন্যদের ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুরো মদীনা নগরী মৃত্যপুরীর রূপ পরিগ্রহ করে।
মদীনা তায়্যিবায় ম্যাসাকার সম্পন্ন করে মুসলিম ইবন উকবা হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ির রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যার উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে সৈন্য রওয়ানা করে। পথিমধ্যে মুসলিম অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং হুসাইন ইবন নুমায়িরকে সেনাধ্যক্ষ নিয়োগ করে। ইবন নুমায়ির’র নিয়োগ সম্পন্ন করে মুসলিম মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
হুসাইন ইবন নুমায়ির’র নেতৃত্বে ইয়াযিদ বাহিনী মক্কা অবরোধ করে। দুই মাস ধরে সে অবরোধ দীর্ঘায়িত হয়।হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ির রাদিয়াল্লাহু আনহু বীর বিক্রমে মুকাবেলা চালিয়ে চান। তাঁকে পরাস্ত করতে ইয়াযিদ বাহিনী মিনজানিকের সাহায্যে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে পবিত্র কা’বা ঘরের দেয়াল ধ্বসিয়ে দেয়। এমনকি নিক্ষিপ্ত অগ্নিগোলকের কারণে গিলাফে আগুন লেগে কা’বা গৃহ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময়ই পাপাচারী ইয়াযিদের মৃত্যু সংবাদ মক্কায় পৌঁছে। মনোবল হারিয়ে সৈন্য বাহিনী রণেভঙ্গ দিয়ে ফিরে যায় দামেশকে।
পাঠক! এবার একটি হাদীসের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
من اخاف أهل المدينة أخافه الله وعليه لعنة الله والملاءكة والناس اجمعين (مسند احمد ٤:٥٥)
অর্থাৎ যে মদীনাবাসিকে ভীত সন্ত্রস্থ করবে আল্লাহ তাকে ভীত করবেন, আর তার উপর আল্লাহপাক, ফিরিশতাকূল এবং সমস্ত মানব জাতির অভিশাপ।( মুসনাদ আহমাদ ৪:৫৫)
এবার নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করুন, ইয়াযিদ কি নিন্দাবাদ বা অভিশাপ পাওয়ার যোগ্য ?
ইয়াযিদ নিন্দাবাদের উপযুক্ত:
মূলত: অভিশপ্ত ইয়াযিদকে নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা নতুন নয়।যুগে যুগে খারিজী চিন্তা চেতনা ও আকীদায় বিশ্বাসীরা সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সে ধারা দেশে দেশে আজও বহমান। হিজরি ৫১০ সালে জন্মগ্রহনকারি সায়্যিদুনা আবু বাকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর অধ:স্তন পুরুষ ইমাম জামালুদ্দিন আবুল ফারাজ আবদুর রাহমান ইবনুল জাওযি রাহিমাহুল্লাহ আরবি ভাষায় রচনা করেছিলেন الرد على المتعصب العنيد المانع من ذم يزيد নামক প্রামান্য কিতাব। ইয়াযিদকে নিন্দামন্দ করতে তখনকার সময় যারা বিভিন্ন যুক্তির আলোকে বারণ করতো ইমাম ইবনুল জাওযি সেই যুক্তিসমূহ খণ্ডন করে প্রমান করেছিলেন যে, ইয়াযিদ তার কৃত কর্মের জন্যে নিন্দাবাদ এবং অভিশাপ পাওয়ার উপযুক্ত।
ইমাম ইবনুল জাওযি ইন্তিকাল করেছেন ৫৯৭ হিজরিতে। তাঁর রেখে যাওয়া প্রামান্য এবং অনবদ্য কিতাবখানা ৮৪৩ বছর পর প্রথমবারের মত বাংলা অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ যোবায়ের।অনুবাদ কর্মটি সম্পাদনা করেছেন দেশের খ্যাতনামা ইসলামি চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ।
আব্দুল্লাহ যোবায়ের ইসলামি ধারার বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে ইতোমধ্যে নিজের আসন পোক্ত করে নিয়েছেন। তাঁর অনুদিত আর রিসালাতুল কুশায়রিয়্যা, ফুতুহুল গাইব’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ বুদ্ধা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। প্রখর মেধাবী এ তরুণকে অনুবাদ কর্মে দিক নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁরই শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান বহুগ্রন্থ প্রণেতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ। বাংলা ভাষাভাষী অগনন পাঠকের পক্ষ থেকে অনুবাদক এবং সম্পাদক মহোদয়ের প্রতি অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা জানাই। দেশের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশনী ঐতিহ্য প্রকাশিত গ্রন্থখানির বহুল প্রচার কামনা করি।