৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সেরেফ দেশ ভাগ—কথাটাকে আলাপের শুরুতেই নাকচ করে দেন মুসা আল হাফিজ। বলেন, ৪৭ এর দেশভাগ, কথাটাই ফাউল। এটা স্বাধীনতা। প্রশ্ন যেটা গুরুতর, সেটা হচ্ছে, ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্রগঠন। ভারত-পাকিস্তানকে ভাগ করা। বস্তুত এটা ছিলো অনিবার্য। ভালো কোনো বিকল্প ছিলো না।
মুসা আল হাফিজ বলেন, মুসলিমদের একটি বড় অংশ চাইছিলেন অখণ্ড ভারত টিকে থাকুক। কিন্তু টিকে থাকার জায়গাটা এতোই সঙ্কুচিত এবং জটিল হয়ে গিয়েছিল যে, পরিস্থিতি দ্বিজাতিতত্ত্বের দিকে মোড় নেয়। এই মোড়টা নিয়েছে প্রধানত হিন্দুত্ববাদী নেতৃবর্গ এবং ব্রিটিশদের কারণে। হিন্দু-মুসলিম আলাদা জাতি, একসাথে থাকতে পারে না, এমন তত্ত্ব বড় আওয়াজেই উচ্চারিত হচ্ছিল হিন্দুতরফে। হিন্দুমহাসভা তখনই খুব প্রভাবশালী ছিল। এর সভাপতি এবং হিন্দুত্ববাদের তাত্ত্বিক গুরু সাভারকর ১৯৩৭সালেই ঘোষণা করেন, ‘ভারতবর্ষকে আজ আর একটি , অভিভাজ্য ও সুসংহত জাতি মনে করা যায় না। কারণ এ দেশে দুটি জাতির বাস, হিন্দু ও মুসলমান।’ সাভারকরের তত্ত্ব কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় ছিলো না। হিন্দুরাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে জোরে-শোরেই এমনটি বলা হচ্ছিল। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যা পরবর্তীতে বলেছেন, তা আগেই উচ্চারিত হচ্ছিল এই মহলে। কলকাতা টাউন হলে হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশের বিবরণ দিয়েছেন প্রফেসর ড. জয়া চ্যটার্জি, যে সমাবেশে সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. জয়া সমাবেশে প্রদত্ত এক বক্তৃতার উল্লেখ করেছেন, যা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতিধ্বনি। বক্তব্যটি হচ্ছে–‘হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক সাংস্কৃতিক সংশ্লিষ্টতা, তাদের শিক্ষা, ব্যক্তিগত আইন (পারসোনাল ল’) এবং অনুরূপ বিষয়ের প্রেক্ষিতে তাদেরকে পৃথক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং অতঃপর তার কোনোরকম মতভেদ ছাড়াই অল-বেঙ্গল ফেডারেশন এ্যাসেম্বলিতে এক সাথে সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ভ্রাতৃত্বের শর্তে যোগ দিতে পারে। এ ধরনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাই বাংলার জন্য উপযোগী হতে পারে।’
মুসা আল হাফিজ আরও জানান, মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘ভারত যখন স্বাধীন হলো’ গ্রন্থে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। প্যাটেল বলতেন–‘আমরা চাই বা না চাই, ভারতে দু’টি জাতি। এ সত্য মেনে নেয়া ছাড়া গতি নেই।’ ড. জয়া চ্যাটার্জির বক্তব্যে বাস্তবতা আছে, যেখানে তিনি প্রমাণ করেছেন–বর্ণ হিন্দুরাই দুই জাতি তত্ত্ব প্রথম আনে; তারপর মুসলমান নেতারা।’ সাধারণ হিন্দুদের মতামত ছিল একদেশ ধারণার বিপক্ষে। বাংলা যৌথতা ও বিভক্তির প্রশ্নে কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকা ১৯৪৭-্এর মে মাসে একটি জনমত যাচাই করেছিল। জনমতের ফলাফলে তারা জানায় যে, বাংলার সাতানব্বই শতাংশ হিন্দু বাংলা বিভাগ চান। মানে মুসলিমদের সাথে একদেশে না থাকার পক্ষে ছিল জনমত।
দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম উপস্থাপক হিন্দুরা হলেও এর প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয় ব্রিটিশরা। জানান মুসা আল হাফিজ। তিনি বলেন, মুসলিমরা ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন–সবদিক দিয়ে হিন্দুদের তুলনায় ভয়াবহ রকমের পিছিয়ে। বস্তুত তখনকার ভারতে মুসলিমরা প্রায় দলিতদের পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলো। এটা নিশ্চিত করে ব্রিটিশ শাসন। তারা তীব্র করে তোলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত–হত্যাযজ্ঞ এবং প্রলয়। যার প্রধান শিকার ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী। এ বাস্তবতায় আলাদা রাষ্ট্র-ধারণা নিয়ে মুসলিম নেতৃত্বকে সামনে আসতে হয়। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে মুসলিম লীগের সমাবেশে দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানানো হয়। এর ভিত্তিতে যদি দ্বিরাষ্ট্র ব্যবস্থা নাও হতো, মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকাগুলো পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতো। কারণ অবধারিতভাবেই শাসকশ্রেণী হয়ে উঠেছিল হিন্দুরা। প্রশাসন ও রাজনীতিতে হয়তো নানা দেনদরবারের ভিত্তিতে মুসলিমদের অংশীদারিত্ব বাড়ানো যেতো, কিন্তু সাধারণভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে যেত শাসিত ও দ্বিতীয়শ্রেণীর জনগোষ্ঠী হিসেবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলিমরা হয়তো বিচ্ছিন্নতার আওয়াজ তুলত, কিন্তু যেসব এলাকায় মুসলিমরা সংখ্যালঘু, তারা সে আওয়াজে কণ্ঠও মেলাতে পারতো না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কেমন হতো, কাশ্মীর তার একটি নজির মাত্র।
কিন্তু এভাবে দেশভাগ না করে সাংবিধানিকভাবেও তো মুসলিম ও হিন্দুদের ইনসাফপূর্ণ সুবিধা নিশ্চিত করা যেত! এমন প্রশ্নের জবাবে মুসা আল হাফিজ বলেন, এটা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।কারণ, হিন্দু যে বুদ্ধিজীবীশ্রেণী, রাজনীতিবিদ ও গণমতের কথা বললাম একটু আগে, তারাই এটা হতে দিতো না। জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, বল্লভ ভাই প্যাটেলসহ কংগ্রেস নেতারা ছিলেন ভারতের হিন্দুমতাদর্শী রাজনীতি ও সামাজিক বাস্তবতার অংশ। তাদের দ্বারা খুব ভালো কিছু হতো, সে আশাও করার ছিলো না। ইতিমধ্যে হিন্দুত্ববাদের হাতে মুসলিম স্বার্থের প্রতিকূলে ভারতের সংবিধান পরিবর্তন আমরা দেখেছি। ঐক্যবদ্ধ ভারতেও এমনটি ঘটতো।
মুসা আল হাফিজ বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জায়গা থেকে আমি দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পর্কে বলছি, তা নয়। ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে, সামাজিক বাস্তবতা থেকে বলছি। এটি ছিলো অনিবার্য। আর এর ফসল হিসেবে আমরা পেতে সক্ষম হয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ৪৭-এ পূর্বপাকিস্তান হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন না ভারত থেকে আমাদের স্বাধীন হতে হতো। যা ছিলো অত্যন্ত দুঃসাধ্য। কাশ্মীরের মতোই। এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ১৯৪৭ সালেই রচিত হয় ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ভিত্তি। এ কারণে একাত্তরের স্বাধীনতার পূর্বপর্যায় হিসেবে ৪৭ সালের আজাদি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, একাত্তরে যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ১৯৪৭ সালের আজাদির সংগ্রামের এক নিবেদিতপ্রাণ যুবনেতা।
মুসা আল হাফিজ বলেন, যেসব বুদ্ধিজীবি ৪৭-এর আজাদিকে অবজ্ঞা করেন, দ্বিজাতিত্ত্বকে অস্বীকার করেন, তাঁরা হয়তো না বুঝেই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছেন অথবা জেনে-বুঝেই বিভ্রান্ত হচ্চেন।